ধর্মীয় জালসা প্রকৃতপক্ষে ইলমি অনুষ্ঠান । এর মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম শিক্ষা। কিন্তু বর্তমানে এটি আমোদপ্রমোদ, অতিথিভোজন ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির অনুষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। আজকাল অধিকাংশ ধর্মীয় জালসায় মুলত চার ধরনের মানুষের লাভ হয়ঃ ১। প্যান্ডেলওয়ালা, ২। বক্তা, ৩। চাটপাটিওয়ালা, ৪। আয়োজক । আয়োজকরা কিছু পাক আর না পাক সেদিনের ভুরিভোজটা হয়ে যায় আর ক্যাশিয়ার সেক্রেটারি হলে তো কথাই নেই [ ইল্লা মা শা আল্লাহ ]। কার সাধ্য হিসেব চাই!
সন্দেহ নেই সচেতন সমাজ গঠনে শুদ্ধ ওয়াজ মাহফিলের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ওয়াজকারী হতে হবে যোগ্য এবং ধর্মীয় জালসার প্রতিপাদ্য হতে হবে প্রাসংগিক, জীবঘনিস্ট ও ইসলামের মৌলিক আকিদা বা আমল। অপ্রয়োজনীয় অভিনব বিষয় থাকা অনুচিত। ওয়াজকারী দায়িত্ব সর্বাধিক। আমাকে কেউ যদি কোন ধর্মীয় জালসায় ওয়াজ করার জন্য আমন্ত্রন জানান তাহলে আমাকে নিম্নিলিখিত বিষয় সমুহ অবশ্যই ভাবতে হবেঃ
১। পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ইলমি যোগ্যতা : আমাকে সুনিশ্চিত হতে হবে যে, আমার পর্যাপ্ত শিক্ষাগত ইলমি যোগ্যতা আছে কিনা। আমি ডিগ্রির কথা বলছি না। কোন মাদ্রাসা বা দারুল উলুমের ডিগ্রি থাকলেই যে আলেম এবং না থাকলে আলেম নয় এ ধারণা ভূল। ইমামে আহলে সুন্নাত শাইখুল ইসলাম হাফেয ইমাম আহমাদ রেযা খান বেরেলভী রাহিমাহুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়, ‘ ইসলামী বক্তা বা ওয়ায়েয কি আলিম হওয়া আবশ্যক?’ জবাবে তিনি বলেন: ‘আলিম নয় এমন ব্যক্তির ওয়ায করা হারাম।’ এরপরে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ‘আলিমের পরিচয় কী?’ তিনি বলেন: ‘আলিমের পরিচয় হলো- আক্বাইদের ব্যাপারে পরিপূর্ণ অবগত ও স্বয়ং সম্পূর্ণ হওয়া এবং কারো সাহায্য ব্যতিত দীনের জরুরি বিষয়সমূহ কিতাব থেকে নিজেই বের করতে সক্ষম হওয়া।’[ তথ্যসূত্রঃ মালফূযাত-ই-আ‘লা হযরত, পৃষ্ঠা: ৫৮, মাকতাবাতুল মাদীনা, করাচী ]। তবে আলিম নয়, যে শুধু উর্দু (বা বাংলা) পড়তে জানে, এমন ব্যক্তি যদি নিজের পক্ষ থেকে কিছু না বলে বরং আলিমের লিখা (হুবহু) পড়ে শুনায়, তাহলে এতে কোন সমস্য নেই [ তথ্যসূত্রঃ আ‘লা হযরত, আল-ফাতাওয়া আর-রদ্বাভিয়্যাহ্, ২৩/৪০৯, রেযা ফাউন্ডেশন, পাকিস্তান ]। এখানে ভেবে দেখার বিষয় ইমামে আহলে সুন্নাত এর মানদন্ড অনুযায়ী বর্তমান ওয়াজকারীদের মধ্যে কত জন ‘আলেম’ হিসেবে বিশেষিত হওয়ার যোগ্য? কত জন ওয়াজকারী “ আক্বাইদের ব্যাপারে পরিপূর্ণ অবগত ও স্বয়ং সম্পূর্ণ” ? সকলকে আত্মবিশ্লেসন এর আবেদন জানাচ্ছি।
মুদ্রার উল্টো পীঠ হলো, কিছু মানুষ পেশায় শিক্ষক বা ডাক্তার বা ব্যবসায়ী বাংলা-ইংরেজিতে কিছু ধর্মীয় বই পড়েই নিজেকে ‘বিশাল’ আলেম ভাবতে থাকেন। শুদ্ধভাবে কুরআন মাযীদ পাঠ করতে পারেন না কিন্তু ওয়াজ করেন। এদেরও ওয়ায করা বা এদের ওয়াজ শোনা দুটোই অবৈধ। অনুরুপ, ফাসিক্ব ব্যক্তি অর্থাৎ যার নামায-রোযা নেই, সুন্নাহ্ সম্মত দাঁড়ি নেই, পর্দার ধার ধারে না বা শরীয়ত বিরোধী কাজে লিপ্ত এমন ব্যক্তিরও ওয়ায করা নিষিদ্ধ এবং তার ওয়ায শুনাও নিষিদ্ধ ।
২। অর্জিত ইলম অনুযায়ী নিজের ও পরিবারের জীবন যাপনঃ আমাকে এও সুনিশ্চিত হতে হবে যে, আমি আমার ইলম আমার ব্যক্তি-জীবনে কত খানি প্রয়োগ করতে পারছি ও নিজেকে ও নিজের পরবারকে সংশোধন করতে পারছি। আমার পরিবারকে আমি শুদ্ধভাবে কুরআন মাযীদ পাঠ করতে শিখিয়েছি কিনা। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ইসলামী মাসায়েল শিক্ষা দান করেছি কিনা। আমার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে যদি শুদ্ধভাবে কুরআন মাযীদ পাঠ করতে না শিখিয়ে থাকি তাহলে তাদেরকে আগে শিক্ষাদান করতে হবে। পরে জালসা মাহফিলে ওয়াজের আমন্ত্রন গ্রহন করতে হবে।
৩। আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে ওয়াজের ময়দানে আমি যতখানি সময় দিই, নিজের কর্মখেত্রে তার কতটুকু হক আদায় করি। আমি আমার কর্মখেত্রে দেরি করে যায় নাতো! আমি আমার কর্মখেত্র থেকে আগে চলে আসি না তো! আমি আমার নির্ধারিত কর্ম সাধ্যমত সুচারুভাবে পালন করি তো!
৪। বর্তমানে ওয়াজের মায়দান অপরিচ্ছন্ন, উত্তপ্ত ও কাদা ছোঁরাছুড়ির কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে এই পরস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে আমি দায়ী কিনা। বাতিলকে খন্ডন করা অবশ্যই জরুরী। কিন্তু সেটা হবে ইলমী ও গঠনমূলক। শৈলী হবে ইসলামী । গালাগাল আর বানোয়াট দলীল সমাধান হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সহিত তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫
৫। আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের যে আকাবীরগণের আদর্শের কথা তুলে ধরতে চাইছি সেই আকাবীরগণকে আমি কতখানি শ্রদ্ধা করি বা তাদেরকে কতখানি শ্রদ্ধা করি বা সেই আকাবীরগণের পথে নিজে আমি কতখানি চলার চেষ্টা করছি বা তাদের নিয়ত যেমন শুদ্ধ ছিল আমার নিয়ত কি সেরুপ । নাকি নিজের পকেট ভর্তি করার জন্য ঐ মহান মনিষীদেরকে আমরা ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছি। আমি এমন বহু ওয়াজকারীকে চিনি যারা “মাসলাকে আলা হাযরাত” স্লোগান দিয়ে মুখে ফেনা তুলে দেয় কিন্তু আলা হাযরাত রহমাতুল্লাহি আলাইহের একটি বইও পাঠ করে নি।
৬। আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে, ওয়াজকারী, ইমাম বা আলেম হিসেবে আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকারীর উপর কতখানি অবিচল ও নির্ভিক ভাবে কাজ করছি নাকি ইমামতি বাঁচানোর জন্য বা জালসায় নিমন্ত্রন পাওয়ার জন্য কমিটি-মোড়ল_সর্দার-সম্পাদক-সভাপতি-ক্যাশিয়ারকে ইসলাম বিরোধী কাজ কর্ম করতে দেখলেও চোখ বন্ধ করে আলুর মত গড়িয়ে যাচ্ছি। এই বৈশিস্ট ইহুদি নাসারাদের মধ্যে প্রবল ছিল।
৭। জনগণকে নির্লোভ ও নিরাহংকার হওয়ার পরামর্শ দিই কিন্তু আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে, আমার মধ্যে এর কতটুকু চর্চা রয়েছে।
৮। আমি অন্যকে উপদেশ দিই কিন্তু আমাকে আত্মবিশ্লেসন করতে হবে যে অন্যের উপদেশ আমি কতখানি মনোযোগ দিয়ে শুনি বা সেই উপদেশ হজম করার শক্তি আমার মধ্যে কতটুকু রয়েছে।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে সরল পথে অবিচল রাখুন এবং নির্ভিক ভাবে ও হিকমতের সঙ্গে কাজ করার তাওফিক দান করুন !