আল্লাহ পাকের নামে শুরু যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক । সালাত ও সালাম নবীকূলসম্রাট সাইয়িদূনা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।
ইমাম বুখারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী : কুরআন মাজীদের পরে ইসলামের দ্বিতীয় অপরিহার্য উৎস হলো হাদিস শরিফ এবং সকল হাদিস গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক প্রামান্য ও সম্মানিত গ্রন্থ হলো সহীহ বুখারী।[ bukhari shareef] এর সংকলক হলেন বর্তমান উজবেকস্থানের সমরকান্দ প্রদেশে অবস্থিত বুখারার অধিবাসী শাইখুল ইসলাম ফিল হাদিস ইমাম ইসমাইল বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হ। ইমাম বুখারির পুরো নাম আবু ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমা’ঈল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ্ আল বুখারী আল-জু’ফী (জন্ম ১৯৪ হিঃ – মৃত্যু ২৫৬ হিঃ) এবং তাঁর গ্রন্থ সহীহুল বুখারির পুরো নাম আল-জামি আস-সহীহ আল-মুসনাদু মিন উমুরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি । পৃথিবীর প্রায় দেড়শটি ভাষায় এ পর্যন্ত এই গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে । ইমাম ইবনে আল সালাহ বলেন, “দ্বিরুক্তি সহ বুখারী শরীফে হাদীসের সংখ্যা ৭২৭৫। বলা হয়েছে যে মাত্র একবার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২,২৩০ [ তথ্যসূত্রঃ মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ, খন্ড নং ১, পৃষ্ঠা নং ২০ ]।
ইমাম বুখারীর জন্ম ও মৃত্যু : ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হ ছিলেন অনন্য পন্ডিত ও মহান চরিত্রের অধিকারী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। তার পিতামাতা উভয়েই ছিলেন আল্লাহর ওলী। ইমাম বুখারি যে আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমাত-প্রাপ্ত বান্দা ছিলেন তা তাঁর শৈশবের ঘটনাবলী থেকে সুপরিস্ফুট হয়ে ওঠে। শৈশবে এক অসুখে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তাঁর মার দু’আর ফলশ্রুতিতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাকে স্বপ্নে জানান যে আল্লাহ তা’আলা তার ছেলেকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে শিশু ইসমাইল বুখারি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন। পাঁচ বছর বয়সে ইমাম বুখারিকে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ইমাম দাখিলীর শিক্ষালয়ে ভর্তি হন। অন্যদের ন্যায় তিনি খাতা-কলম সঙ্গে নিয়ে যেতেন না। সহপাঠীরা একদিন তাঁকে তিরস্কার করলে তিনি তাদেরকে এত দিন ধরে শ্রুত অজস্র হাদীস ইমাম হুবহু ধারাবাহিক তাদেরকে শুনিয়ে দিলেন। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারীর প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ষোল বছর বয়সে তিনি প্রসিদ্ধ হাদিস সংকলকদের গ্রন্থসমুহ মুখস্থ করে ফেলেন। হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র কুফা, বসরা, বাগদাদ, সিরিয়া, মিসর, খুরাসান প্রভৃতি শহরে বার বার সফর করেন । তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ইমাম মক্কী ইবন ইবরাহীম, ইমাম আবূ আসিম, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম আলী ইবনুল মাদানী, ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াসহ, ইমাম হুমায়দী, ইমাম ইয়াহ্ইয়া, ইমাম উবায়দুল্লাহ ইবন মুসা ও ইমাম মুহাম্মদ ইবন সালাম আল বায়কান্দী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারীর অবদানঃ ইমাম বুখারির মোট তিন লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। এর মধ্যে এক লাখ হাদিস ছিলো সহীহ ও দু’লাখ হাদিস ছিলো গায়ের সহীহ ।[ তথ্যসূত্রঃ মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ, খন্ড নং ১, পৃষ্ঠা নং ২০ ]। বিদআতিরা মনে করে যে কেবল সহিহ হাদিসই গ্রহনযোগ্য আর গাইর সহিহ হাদিস অর্থ জাল হাদিস। কিন্তু উসুলে হাদিস সম্পর্কে জ্ঞাত তালিবে ইলমরা জানেন না গাইর সহিহ হাদিস অর্থ জাল হাদিস নয়। গাইর হাদিস দ্বারা হাসান হাদিসও বোঝানো হতে পারে। গাইর হাদিস দ্বারা যাইফ হাদিসও বোঝানো হতে পারে। এখানে আর একটি জিনিস স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে যাইফ হাদিস অর্থ জাল হাদিস নয় যেমনটা কিছু বিদআতি মনে করে। যাইফ হাদিসের প্রায় পনেরটি প্রকার রয়েছে। এই পনের প্রকার যাইফ হাদিসের মধ্যে মাত্র দু ধরনের যাইফ বর্ননা জাল হতে পারে। গাইর সহিহ হাদিস অর্থ যে জাল হাদিস নয় তার সব চেয়ে উৎকৃষ্ট দলিল হলো ইমাম হাদিসের দু লাখ গাইর সহিহ হাদিস মুখস্থ রাখা।
এখানে আর একটি কনফিউশান নিরসন করা জরুরি। সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম নিঃসন্দেহে সহীহ হাদীসের গ্রন্থ। কিন্তু এ কথা ঠিক নয় যে, সমস্ত সহীহ হাদীসই যে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে ইমাম বুখারী স্বয়ং বলেন
فَقَدْ رُوِّينَا عَنِ الْبُخَارِيِّ أَنَّهُ قَالَ: ” مَا أَدْخَلْتُ فِي كِتَابِي (الْجَامِعِ) إِلَّا مَا صَحَّ، وَتَرَكْتُ مِنَ الصِّحَاحِ لِحَالِ الطُّولِ
ইমাম বুখারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ আমি আমার সহীহ বুখারীতে সহীহ হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস আনিনি। কিন্তু আমি অনেক সহীহ হাদীস আমার কিতাবের কলেবর বড় হবার শংকায় বাদ দিয়েছি [ তথ্যসূত্রঃ মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ, খন্ড নং ১, পৃষ্ঠা নং ১৯ ]। ইমাম মুসলিমও বলেছেনঃ
وَرُوِّينَا عَنْ مُسْلِمٍ أَنَّهُ قَالَ: ” لَيْسَ كُلُّ شَيْءٍ عِنْدِي صَحِيحٌ وَضَعْتُهُ هَاهُنَا – يَعْنِي فِي كِتَابِهِ الصَّحِيحِ –
ইমাম মুসলিম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ আমার কাছে “সহীহ” হিসেবে গণ্য সব হাদীসই আমার কিতাবে আনিনি [ তথ্যসূত্রঃ মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহ, খন্ড নং ১, পৃষ্ঠা নং ২০ ]। ইমাম ইবনে কাছীর বলেনঃ
ثم إن البخاري ومسلماً لم يلتزما بإخراج جميع ما يحكم بصحته من الأحاديث، فإنهما قد صححا أحاديث ليست في كتابيهما، كما ينقل الترمذي وغيره عن البخاري تصحيح أحاديث ليست عنده، بل في السنن وغيرها.
নিশ্চয় ইমাম বুখারী ও মুসলিম তারা সকল সহীহ হাদীসকে তাদের কিতাবে একত্র করাকে আবশ্যক করে নেননি। তারা উভয়ে এমন অনেক হাদীসকেই সহীহ বলেছেন, যা তাদের কিতাবে নেই। যেমন ইমাম বুখারী নিজেই সহীহ বলেছেন এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন ইমাম তিরমিজী [ইমাম বুখারীর ছাত্র] ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ।অথচ সেসব হাদীস ইমাম বুখারীর কিতাবে পাওয়া যায় না। বরং তা রয়েছে সুনান ও অন্যান্য গ্রন্থসমূহে [ তথ্যসূত্রঃ ইখতিছারু উলুমিল হাদীস, খন্ড নং ১, পৃষ্ঠা নং ২৫]
ইমাম বুখারীর হাদিস সংকলনের ইতিহাস : এখানে আর একটি কনফিউশন নির্মুল হওয়া অপরিহার্য। বিদআতিরা মনে করে যে আম্বীয়ায়ে কেরাম ও আওলিয়ায়ে কেরাম মরে মাটিতে মিশে গেছে। ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হ এই বিদআতি আকীদাকে চূর্ন করেছেন । আপনি কি জানেন যে আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ইমাম বুখারি তার এই অমর গ্রন্থ রচনা করেছেন রসুল পাকের রাওযায়ে আকদাসের পাশে দীর্ঘ ১৬ বছর বসে ? আপনি কি জানেন যে আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদিস ইমাম বুখারি তার এই অমর গ্রন্থ রচনার সময় দীর্ঘ ১৬ বছর নবীকূল সম্রাট সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রাওযায়ে আকদাসের পাশে বসে প্রতিটি হাদীস গ্রন্থিত করার পূর্বে মোরাকাবার মাধ্যমে রাসূল পাকের সম্মতি লাভ করতেন।? আসুন দলিল দেখে নিই। এই বিদআতিদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত সহিহ বুখারির [bukhari shorif ]
বাংলা অনুবাদ এর মহাপরিচালকের কথা অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে, “ ইমাম বুখারী বহু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করে সনদ সহ প্রায় ছয় লাখ হাদীস সংগ্রহ করেন এবং দীর্ঘ ১৬ বছর নবীকূল সম্রাট সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রাওযায়ে আকদাসের পাশে বসে প্রতিটি হাদীস গ্রন্থিত করার পূর্বে মোরাকাবার মাধ্যমে রাসূল পাকের সম্মতি লাভ করতেন। এভাবে তিনি প্রায় সাত হাজার হাদীস চয়ন করে তাঁর সহীহ বুখারী [ sahih bukhari] সংকলনটি চূড়ান্ত করেন। (তথ্যসূত্রঃ- বুখারী শরীফ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অনুবাদ, মহাপরিচালকের কথা অধ্যায়)।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে সঠিক পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন।