বর্তমানে মুসলমানদের রয়েছে ২০০ কোটি জনসমস্টি এবং ৫৭ টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। মুসলমানদের এই বিপুল জনবসতি ইতিহাসে কখনো ছিল না। বর্তমানে মুসলমানদের কাছে যত উপায়-উপকরণ রয়েছে , ইতিহাসে কখনো এমনটি ছিল না। বিশ্ব মানচিত্রের একেবারে মধ্য বা কেন্দ্রভাগ মুসলমানদের দখলে। সারা পৃথিবীর জলপথে বাণিজ্যিক পণ্যাদি আমদানি-রপ্তানির প্রধান সড়কগুলো মুসলমানদেরই অধীনে। তেল, যা আধুনিককালে তরল স্বর্ণ হিসেবে বিবেচ্য, এর ওপর মুসলমানদের দখল ৭৫ শতাংশ। বিপুল অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী আরব বিশ্ব । তথাপিও এই উম্মাহ বিশ্বে আজ এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যে মুসলিম উম্মাহ এক সময় পৃথিবীকে উপহার দিয়েছিল ন্যায়-নীতি, ইনসাফ ও সততা এবং অর্জন করেছিল বিশ্ব নেতৃত্ব, সেই জাতির রক্ত আজ পশ্চিমারা কাকলাসের ন্যায় চুষে খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এত কিছু থাকা সত্বেও কেন মুসলমানদের আজ বিশ্বজুড়ে এমন বিপর্যয়? কেন তারা নির্যাতীত-লাঞ্ছিত? কেন আজ শত্রুরা মুসলিম উম্মাহর উপর দাপট দেখাতে পারছে? কেন আজ শত্রুরা সফল?
১ নং কারণঃ ঈমান এমন একটি শব্দ যে মুসলিম হিসাবে সবাই এই শব্দটির সাথে পরিচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে আমরা নিজেদেরকে মুসলিম হিসাবে ঈমানদার হিসাবে দাবী করলেও মূলত ঈমান কাকে বলে এ সম্পর্কে বহু ভাই-বোন এর নিকট এ ধারণা স্পস্ট নয় যে ইমান কাকে বলে। কেউ কেউ মনে করেন যে, নামায পড়া কিংবা রোযা রাখার নামই ইমান। কেউ কেউ মনে করেন যে, ফাতেহা-চল্লিশা-উরস করার নাম ইমান। কেউ এক ধাপ এগিয়ে সহীহ মুসলিমের হাদীস থেকে বলেন যে, ঈমান মূলত ছয়টি বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর সেগুলো হলো- ১. আল্লাহ। ২. ফেরেশতা। ৩. আসমানী কিতাব। ৪. নবী-রাসুল। ৫. শেষ দিবস ও পুনরুত্থান এবং ৬. ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপণ করা।
ভাষ্যঃ ঈমানের বিপরীত কুফর। ঈমান সত্য, কুফর মিথ্যা। ঈমান আলো, কুফর অন্ধকার। । আসুন, ইসলামের প্রথম স্তম্ভ ঈমান সম্পর্কে আমরা ধারণা সুস্পস্ট করে নিই। ‘ঈমান’ এর সাধারণ অর্থ হলো বিশ্বাস করা, আনুগত্য করা, অবনত হওয়া, নির্ভর করা ইত্যাদি। এ কথা ঠিক যে, ইমান বলতে ছয়টি বিষয়ের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে , এ সম্পর্কে সহীহ মুসলিমে হাদীস বর্নিত আছে।কিন্তু যে সুক্ষ্ম বিসয়টি আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি তা হল এই হাদীস শরীফটি ইমান সম্পর্কে একমাত্র হাদীস নয় এবং সহীহ মুসলিমের এই হাদীসটি আমরা গভীরে গিয়ে বোঝার চেস্টা করি না। ইমান বলতে ছয়টি বিষয়ের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, এটুকু ঐ হাদীসের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ মাত্র। এই হাদীস শরীফেই ইসলামের পরিচয় দেওয়া আছে যা আমরা আলোচনাই নিয়ে আসি না। এর সঙ্গে আরও রয়েছে আল কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য সহীহ হাদীস। একটি হাদিসকে আংশিক ভাবে গ্রহন করে এবং আল কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য সহীহ হাদীসকে পাশ কাটিয়ে আমরা চরম ও একচেটিয়া মত প্রকাশ করতে পারি না। তাই আমরা এ সম্পর্কে সংশ্লিস্ট সকল দলীলের আলোকে ইমানের হাকীকাত বোঝার চেস্টা করব।
১। আমরা সহীহ মুসলিমের ঐ হাদিসখানি আলোচনা করব যেখানে ইমান বলতে ছয়টি বিষয়ের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে।
ثُمَّ قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ لاَ يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ وَلاَ يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ وَقَالَ يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الإِسْلاَمِ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً . قَالَ صَدَقْتَ . قَالَ فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ . قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإِيمَانِ . قَالَ ” أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ ” . قَالَ صَدَقْتَ . قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ الإِحْسَانِ . قَالَ ” أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ” . قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ . قَالَ ” مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ ” . قَالَ فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَتِهَا . قَالَ ” أَنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَهَا وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِي الْبُنْيَانِ ” . قَالَ ثُمَّ انْطَلَقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا ثُمَّ قَالَ لِي ” يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ ” . قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ . قَالَ ” فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ ” .
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) বললেন, আমার পিতা ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ একদা আমরা রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আমাদের সামনে আবির্ভূত হলো। তারপরনের কাপড়-চোপড় ছিল ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো ছিল মিশমিশে কালো। সফর করে আসার কোন চিহ্নও তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। আমাদের কেউই তাঁকে চিনেও না।
অবশেষে সে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে বসলো। সে তাঁর হাঁটুদ্বয় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাঁটুদ্বয়ের সাথে মিলিয়ে দিলো এবং দুই হাতের তালু তাঁর (অথবা নিজের) উরুর উপর রাখলো এবং বললো, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! আমাকে ইসলাম সম্বন্ধে বলুন। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ইসলাম হচ্ছে এই- তুমি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন ইলাহ (মা‘বুদ) নেই, এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রসূল, সলাত কায়িম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমাযানের সওম পালন করবে এবং যদি পথ অতিক্রম করার সামর্থ্য হয় তখন বাইতুল্লাহর হাজ্জ করবে। সে বললো, আপনি সত্যই বলেছেন। বর্ণনাকারী [‘উমার (রাঃ) ] বলেন, আমরা তাঁর কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হলাম। কেননা সে (অজ্ঞের ন্যায়) প্রশ্ন করছে আর (বিজ্ঞের ন্যায়) সমর্থন করছে। এরপর সে বললো, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর প্রেরিত নাবীগণ ও শেষ দিনের উপর ঈমান রাখবে এবং তুমি তাকদীর ও এর ভালো ও মন্দের প্রতিও ঈমান রাখবে। সে বললো, আপনি সত্যই বলেছেন। এবার সে বললো, আমাকে ‘ইহসান’ সম্পর্কে বলুন। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘ইহসান’ এই যে, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে যেন তাঁকে দেখছো, যদি তাকে না দেখো তাহলে তিনি তোমাকে দেখছেন বলে অনুভব করবে। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কিয়ামাত সম্বন্ধে বলুন! রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি বেশি কিছু জানে না। অতঃপর সে বললো, তাহলে আমাকে এর কিছু নিদর্শন বলুন। তিনি বললেন, দাসী তাঁর মনিবকে প্রসব করবে [১৫] এবং (এককালের) নগ্নপদ, বস্ত্রহীন, দরিদ্র, বকরীর রাখালদের বড় দালান-কোঠা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় গর্ব-অহংকারে মত্ত দেখতে পাবে। [১৬] বর্ণনাকারী [‘উমার (রাঃ) ] বলেন, এরপর লোকটি চলে গেলো। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, হে ‘উমার! তুমি জান, এ প্রশ্নকারী কে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই অধিক জ্ঞাত আছেন। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তিনি জিবরীল। তোমাদের কাছে তিনি তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১ম খণ্ড, ১; বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ১ম খণ্ড, ১)
লক্ষ্য করুন , ইসলামের ভিত্তি কালেমা শাহাদাত এর মধ্যেই ইমানের হাকীকাত লুকিয়ে আছে। কালেমা শাহাদাত এর অর্থ ও তাৎপর্য সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করলে আমরা ইমানের হাকীকাত বুঝতে পারব। যে হাদীস শরীফে আমাদের আকা ও মাওলা সাইয়িদুনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কালেমা শাহাদাত আমাদেরকে এভাবে শিখিয়েছেন –
উচ্চারণ – আশহাদু আল্লাইলাহা ইলল্লালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
অর্থ – আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বান্দাহ ও রাসূল।
দেখ ভাই, তুমি সাক্ষ্য দিচ্ছো যে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। একটু ভাবো ! সাক্ষ্য কে প্রদান করে ? যে দেখে সেই সাক্ষ্য প্রদান করে। তুমি কি আল্লাহকে দেখেছো যে তুমি আল্লাহর উলুহিয়াত বা উপাস্য হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছো ? না, আসলে আমরা আল্লাহকে না দেখেই আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করছি। এটিই হচ্ছে ইমান বিল গাইব। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন – অর্থাৎ ‘‘তারাই, যারা না দেখে ইমান আনে।” {কানযুল ইমান, সুরা বাকারা, সুরা নং ২, আয়াত নং ৩}
তাহলে, আমরা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে ইমান কিসের ভিত্তিতে এনেছি ? উত্তর হলো, আমরা আল্লাহকে না দেখেই তাকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এক মহান ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে যিনি আল্লাহর হাকীকাতকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই মহান সত্বা সাইয়িদুনা রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কে সত্যবাদি সংবাদদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে আল্লাহ পাককে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করার নামই ইমান। এখানে একটি সুক্ষ বিষয় সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরী। যদি কেউ আমাদের আকা ও মাওলা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মাধ্যম ব্যতিরেকে অর্থাৎ তাকে সত্যবাদি সংবাদদাতা হিসেবে না মেনে নিজের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা বা দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের অনুসন্ধান অনুযায়ী আল্লাহকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে এর নাম ইমান নয়। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাক্ষ্যর উপর আমাদের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সাক্ষ্যই আমাদের সাক্ষ্য। এটিই ইমান। হুযুর কর্তৃক একত্ববাদের সাক্ষ্য দেওয়ার তাৎপর্য হলো, সমগ্র সৃষ্টিকুলে যত বস্তু এবং অস্তিত্ব রয়েছে, আমার হুযুর তার প্রতিটি অনুকনা প্রত্যক্ষ করেছেন, যাচাই করেছেন এবং গবেষণা করেছেন। তিনি মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলাকেও সরাসরি দেখেছেন এবং এর ভিত্তিতে দৃপ্তকন্ঠে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে সৃষ্টিকুলের কোন অস্তিত্বই উপাসনার উপযুক্ত নয়, কেবল আল্লাহ সুবহানাহু তাআলাই উপাস্য। সুতরাং, আমাদের ইমানের সূচনা হয় রাসুল পাকের প্রত্যক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে। যে সব বিষয় তিনি আমাদের নিকট পেশ করেছেন, না দেখে সেগুলোর উপর আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ইমান।
২। আল্লাহ পাক বলেনঃ
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاهِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا لِّتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ تُعَزِّرُوۡهُ وَ تُوَقِّرُوۡهُ ؕ وَ تُسَبِّحُوۡهُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا
অনুবাদঃ নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে [ হাজির ও নাজির রুপে] , সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর [ সূরা সূরাহ ফাতাহ, সূরা নং ৪৮, আয়াত নং ৮-৯]
আল্লাহ পাক দ্বীন ইসলামকে প্রেরণ করেছেন তিনটি উদ্দেশ্যে। প্রথমতঃ মানব সম্প্রদায় যেন মহান আল্লাহ ও তার রসুল সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান নিয়ে আসে।দ্বিতীয়তঃ হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি মানুষেরা যেন সম্মান প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।।তৃতীয়তঃ আল্লাহ পাকের উপাসনায় যেন মগ্ন হয়।
আল্লাহ পাক কর্তৃক উদ্দেশ্য তিনটির মার্জিত ক্রম ও সুবিনস্ত্যকরনের প্রতি লক্ষ্য করুন ! মহান আল্লাহ সর্বপ্রথমে ঈমানের কথা, সর্বশেষে তাঁর (আল্লাহর) ইবাদতের কথা এবং মধ্যস্থলে প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি অসীম প্রেম বা সম্মান প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, ইমান ও পরিত্রানের মূলভিত্তি বা প্রানশক্তি হল হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অসীম প্রেম ও শ্রদ্ধা। বহু ইহুদি-খ্রষ্টান হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং হুযুরের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখনী ও বক্তৃতা প্রদান করে, কিন্তু যেহেতু তারা ঈমান নিয়ে আসেনি সেহেতু তাদের এ সকল ক্রিয়া হল অনর্থক। অনুরুপ, হুযুরপাক সাল্লাল্লাহ আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা ব্যাতিরেকে যদি সারাজীবন পালন কর্তার ইবাদতে লিপ্ত থাকা হয়, তাহলেও সেই সকল ইবাদত হবে ব্যর্থ ও প্রত্যাবর্তিত।
২ নং কারণঃ এবাদাত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাব। আমরা অধিকাংশ লোকই মনে করি যে, কেবল নামায-রোযা-হজ-যাকাত, এগুলোই হল এবাদাত। এভাবে আমরা ইসলামকে মাসজিদের চার দেওয়ালের মধ্যে এবং কিছু রসম-রেওয়াজ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছি।
৩ নং কারণঃ ইশকে রসূল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাব। আল্লাহর বিধান সাইয়িদূনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের গোলামী, ভালোবাসা ও আত্মিক সংযোগ এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুস্টি অর্জনের মৌলিক লক্ষ্য থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
৪ নং কারণঃ তাওহীদ, শির্ক ও বিদআত সম্পর্কে ভূল ব্যখ্যা এবং ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি
৫ নং কারণঃ বিশেষজ্ঞ আলেমদের স্মরনাপন্ন না হওয়া
৬ নং কারণঃ দুনিয়ার ভালোবাসায় নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া ও মৃত্যুকে ভূলে যাওয়া। আমরা অধিকাংশই ধর্মজ্ঞানহীন কিংবা ধর্মবিমুখ। ভোগ বিলাসিতা ও পাশবিক চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত ।
৭ নং কারণঃ শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাদপদতা, বিশেষত দ্বীনের মৌলিক জ্ঞানের অভাব । এখানে শিক্ষা বলতে আমি জেনারাল শিক্ষা এবং দ্বীনি শিক্ষা, উভয় শিক্ষাকেই বোঝাচ্ছি। যারা অশিক্ষিত তাদের তো কথাই নেই, বরং যারা শিক্ষিত, তাদের শিক্ষাও খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ন। যারা দ্বীনি শিক্ষা গ্রহন করছেন তারা জাগতিক শিক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ন অন্ধকারে থাকেন আর যারা জাগতিক শিক্ষা গ্রহন করছেন তারা দ্বীনি শিক্ষা সম্পর্কে সম্পূর্ন অন্ধকারে থাকেন।
৮ নং কারণঃ শিক্ষা কে আল্লাহর সন্তুস্টি ও জ্ঞ্যানার্জনের বদলে ব্যবসা ও আর্থিক উপার্জন কিংবা এর অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা।
৯ নং কারণঃ নিজেদের সোনালী ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা।
১০ নং কারণঃ ইহুদি-খৃস্টান শক্তির ইসলামের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র এবং মুসলিম নামধারী কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতা
১১ নং কারণঃ পশ্চিমা সংস্কৃতিকে নিজ সংস্কৃতি হিসেবে গ্রহন করা। বস্তুবাদি শিক্ষায় লালিত প্রজন্ম, নামে মুসলমান কিন্তু বাস্তবে তারা পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বিজাতীয় সংস্কৃতির দ্বারা তারা এত বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে সে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও হীনমন্যতায় ভোগে।
১২ নং কারণঃ সত্য কথা বলা, সৎ কাজে নির্দেশ প্রদান এবং অন্যায়-মন্দ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলা।
১৩ নং কারণঃ এই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা যে মুসলিম উম্মাহর পূনুরজাগরণ সম্ভব। এমনকি আমরা উম্মাহর বিপর্যস্ত অবস্থার উপর আত্ম-সন্তোষ প্রদর্শন করতেও লজ্জা বোধ করি না।
১৪ নং কারণঃ প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে পশ্চাদপদতা।
১৫ নং কারণঃ আল্লাহ ও তার হাবীবের প্রদান করা বিধানের পরিবর্তে মানব-রচিত বিধানকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা।
১৬ নং কারণঃ সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে হতাশ হয়ে পড়া এবং দ্বীন প্রচারে বিমুখ হয়ে পড়া
১৭ নং কারণঃ সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব অজ্ঞ-অযোগ্য-ধর্মজ্ঞানহীনদের হাতে চলে যাওয়া । প্রয়োজন সমাজ পরিচালনায় উলেমায়ে কেরামের ভূমিকা পূনঃপ্রতিষ্ঠা
১৮ নং কারণঃ পশ্চিমা শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব বলে অবিশ্বাস করা
১৯ নং কারণঃ মিডিয়ার উপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়া
২০ নং কারণঃ আল্লাহর উপরে ভরসা না করা
এর মূল কারণ হল, তারা আল্লাহর বিধান সাইয়িদূনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের গোলামী, ভালোবাসা ও আত্মিক সংযোগ এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুস্টি অর্জনের মৌলিক লক্ষ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অধিকাংশরা, বিশেষ করে বস্তুবাদি শিক্ষায় লালিত প্রজন্ম, নামে মুসলমান কিন্তু বাস্তবে তারা পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তারা দোটানায় ভোগে আর বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তহীনতার জীবন যাপন করে। তারা কেউ ধর্মজ্ঞানহীন। কেউ ধর্মবিমুখ। তারা ভোগ বিলাসিতা ও পাশবিক চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত থাকে। অন্যায়-অত্যাচার ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস হারিয়ে ফেলেছে।
তারা এই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে যে মুসলিম উম্মাহর পূনুরজাগরণ সম্ভব। এমনকি তারা উম্মাহর বিপর্যস্ত অবস্থার উপর আত্ম-সন্তোষ প্রদর্শন করতেও লজ্জা বোধ করে না। তারা সৃজনশীল মানসিকতা বর্জন করেছে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির উপর সানন্দে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আবিস্কার, উদ্ভাবন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব, তারা কোনমতেই তা মানতে রাজী নয়। বিজাতীয় সংস্কৃতির দ্বারা তারা এত বেশি প্রভাবিত হয়েছে যে সে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও হীনমন্যতায় ভোগে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক সকল ক্ষেত্রে তাদের মনোভাব নতজানুমূলক। তারা সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে হতাশ হয়ে পড়েছে এবং দ্বীন প্রচারে বিমুখ হয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহ ও তার হাবীবের প্রদান করা বিধানের পরিবর্তে মানব-রচিত বিধানকে অধিক গুরুত্ব দিতে আরভ করেছে। এগুলোর পেছনে কাজ করছে ইমানের দূর্বলতা ও ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞতা।