আল্লাহর নামে শুরু করছি। সকল প্রশংসা আল্লাহর এবং দরুদ ও সালাম মানবতার কান্ডারী সাইয়িদুনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উপর।
একজন মুসলিমের উপর সব চেয়ে বড় ফরয হলো এতটুকু দ্বীনি বিদ্যা অর্জন করা যার দ্বারা সে নিজের জীবন ইসলামি বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করতে সমর্থ হয়। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে ” طلب العلم فريضة على كل مسلم ” অর্থাৎ প্রতিটি মুসলিম এর উপর দ্বীনী ইলম শিক্ষা গ্রহণ করা ফরজ [ তথ্যসূত্রঃ ইবনে মাযাহ, হাদীস নং- ২২৪]। এই পরিমাণ বিদ্যা অর্জন না করলে ইসলামী বিধান অনুযায়ী স্বীয় জীবন যাপন করা যেমন অসম্ভব, অনুরুপ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতির দায়িত্ব পালন করাও অসম্ভব। আল্লাহ পাক রব্বুল ইজ্জাত সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেনঃ
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يعلمون
অনুবাদঃ হে হাবীব আপনি বলে দিন, যে ব্যক্তি (কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়াতের বিধান) জানে আর যে জানে না, তারা কি উভয়ে সমান গতে পারে? [ সুরা যুমার, আয়াত নং ৯]। তার মানে কখনই সমান হতে পারে না।কিন্তু বর্তমানে চিত্র সম্পূর্ন উল্টো । আজকাল এমন লোকজন ( ইল্লা মাশা আল্লাহ ) কমিটি পরিচালনা করেন যাদের সঙ্গে ফারযে আইন দ্বীনি বিদ্যার কোন সম্পর্ক নেই। এরা ইমাম আলেওদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তাদের মন মতো না চললে তাৎক্ষণিক ইমাম সাহেবকে চাকরিচ্যুত করে। তারাই বড় আলেমের ভাব দেখায়। শরী‘আতে না থাকলেও তাদের মন যা চায়, তাই শরী‘আত মনে করে চালিয়ে দেয়। এরাই মূর্খ পন্ডিত। এরা নিজেরা পথভ্রষ্ট এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে। এদের দাপটেই মসজিদগুলো বর্তমানে প্রচলিত নোংরা রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রথম যোগ্যতাঃ ফলে ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার জন্য প্রথম মৌলিক শর্ত হলো তাকে অবশ্যই ফারযে আইন দ্বীনি বিদ্যা অর্জন করতে হবে। এই যোগ্যতা না থাকলে কেউ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার যোগ্য নয়। যদি এই যোগ্যতা না থাকা সত্বেও কমিটিতে তাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব আসে তাহলে তাকে এই প্রস্তাব বিনীত ভাবে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তাকে প্রথমে উপরে উল্লেখিত যোগ্যতা অর্জন করতে হবে ও তার পরে কমিটিতে আসতে হবে। পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী যদি কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেও নেওয়া হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির উপর অপরিহার্য হলো সে নিজেকে মনে মনে এই কাজের অনুপযুক্ত মনে করবে এবং পাশাপাশি ফারযে আইন বিদ্যা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। খলিফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বলেন যে তোমরা নেতৃত্ব লাভের আগেই জ্ঞান হাসিল করে নাও। আবূ আবদুল্লাহ্ বুখারী বলেন, আর নেতা বানিয়ে দেওয়ার পরও জ্ঞান অর্জন চালিয়ে যাও কেননা সাহাবীগণ বয়োবৃদ্ধকালেও ইলম শিক্ষা করেছেন [ সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইলম, বাব ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে সমতুল্য হওয়ার আগ্রহ ]। সহীহ বুখারীতে আরও বর্নিত আছে যে যখন কোন অনুপযুক্ত ব্যক্তির উপর কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে [ সহিহ বুখারি, হাদীস নং ৬৪৯৬ ] খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয বলেন, যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া আমল করবে, সে সঠিকভাবে কাজ সম্পাদনের পরিবর্তে ধ্বংস করবে তার চেয়ে বেশি [ তারীখে তাবারী, খন্ড নং ৬, পৃষ্ঠা নং ৫৭২ ]। শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাষী সকলেই সমাজ পরিচালনার জন্য যোগ্য। কিন্তু তাকে অবশ্যই উল্লেখিত ফারজে আইন শিক্ষার অধিকারী হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এমন লোকজন নেতৃত্বে আছেন যারা ফারযে আইন বিদ্যার্জন তো দূরের কথা, কালেমা তৈয়বা শুদ্ধ ভাবে পাঠ করতে কিংবা ফরয গোসল কিভাবে করতে হয় জানেন না। ফলতঃ তারা সর্বদা অপবিত্রই থাকেন। কেউ প্রতিদিন দাড়ি কাটার মত হারাম কাজ করেন। বহু স্থানে সভা বিসমিল্লাহ , হামদ ও দরুদ ছাড়াই সম্পন্ন হয় । অধিকাংশ সম্পাদক, সভাপতি বা সদস্যবর্গ মাখরাজ ও তাজবীদের সঙ্গে কুরআন পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে অসচেতন। তাঁদেরকে সংশোধনের অনুরোধ করলে তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন যে, এগুলো ছোটখাটো বিষয়। অনেকে এর চেয়েও গর্হিত মন্তব্য করেন। একবারও জানার চেস্টা করেন না যে, এর ফলে ইমান নিরাপদ থাকল নাকি নস্ট হয়ে গেল! সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে যে,
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَمَنْ تَوَلَّى مِنْ أُمَرَاءِ الْمُسْلِمِينَ شَيْئًا فَاسْتَعْمَلَ عَلَيْهِمْ رَجُلًا وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّ فِيهِمْ مَنْ هُوَ أَوْلَى بِذَلِكَ وَأَعْلَمُ مِنْهُ بِكِتَابِ اللهِ وَسُنَّةِ رَسُولِهِ، فَقَدْ خَانَ اللهَ وَرَسُولَهُ وَجَمِيعَ الْمُؤْمِنِينَ، وَمَنْ تَرَكَ حَوَائِجَ النَّاسِ لَمْ يَنْظُرِ اللهُ فِي حَاجَتِهِ حَتَّى يَقْضِيَ حَوَائِجَهُمْ وَيُؤَدِّي إِلَيْهِمْ بِحَقِّهِمْ،
অনুবাদ- হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের পক্ষ থেকে কোন বিষয়ে যিম্মাদার নিযুক্ত হয়, তারপর সে তাদের উপর কোন ব্যক্তিকে [কোন কাজের] কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, অথচ সে জানে যে, মানুষদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছে, যে তার চেয়েও অধিক যোগ্য এবং কুরআনও হাদীসের অধিক জ্ঞান রাখে, তবে সে অবশ্যই আল্লাহ ও তার রাসূল এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে খেয়ানত করল। আর যে ব্যক্তি মানুষের প্রয়োজনকে পূর্ণ করল না, আল্লাহ তাআলা উক্ত ব্যক্তির প্রয়োজনও পূর্ণ করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না উক্ত ব্যক্তি মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করে এবং তাদের হক আদায় করে দেয়। [ তাবারানী, আলমুজামুল কাবীর , হাদিস নং ১১২১৬]
আল্লাহ পাকের নির্দেশঃ মসজিদ যারা পরিচালনা করবে তাদের গুণাবলী কী হবে তা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক রব্বুল ইজ্জত স্বয়ং ঘোষণা করেনঃ
إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ.
‘মূলত তারাই আল্লাহর মসজিদ সমূহে আবাদ করবে, যারা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং ছালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। বস্ত্ততঃ তারাই সত্বর হেদায়াতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ [ সুরা তওবাহ, আয়াত নং ১৮]।
দ্বিতীয় যোগ্যতাঃ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হলো আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে [ সুরা তওবাহ, আয়াত নং ১৮]।
তৃতীয় যোগ্যতাঃ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার তৃতীয় শর্ত হলো নামায পাঠ করতে হবে [ সুরা তওবাহ, আয়াত নং ১৮]।
চতূর্থ যোগ্যতাঃ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার চতূর্থ শর্ত হলো যাকাত প্রদান করতে হবে [ সুরা তওবাহ, আয়াত নং ১৮]।
পঞ্চম যোগ্যতাঃ ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার পঞ্চম শর্ত হলো আল্লাহ ছাড়া সে অন্য কাউকে ভয় করে না। [ সুরা তওবাহ, আয়াত নং ১৮]। অর্থাৎ সে যে কাজই করবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করবে। সে যে কথা বলবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বলবে।
সোজা কথায়, ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি হওয়ার জন্য ফারযে আইন বিদ্যায় শিক্ষিত, দ্বীনদার, ও শরীয়তের পাবন্দ হতে হবে। ফাসিক, খিয়ানতকারী, ও শরীয়তের খেলাফ চাল-চলনে অভ্যস্ত কোন ব্যক্তিকে ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ কমিটিতে রাখা যাবে না। যারা অযোগ্যদেরকে ঈদগাহ, মাদ্রাসা বা মসজিদ পরিচালনা কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতি বানাবে সবাই গোনাহগার হবে। যদি সমগ্র সমাজ এমন ব্যক্তিকে কমিটিতে রাখে যারা উপরোক্ত যোগ্যতা অর্জন করে নি তারা তাহলে সমগ্র সমাজ গোনাহগার হবে। সমগ্র সমাজ কেন, সমগ্র পৃথিবী একদিকে হয়ে গেলেও আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলের বিধানের বিপরীতে তাদের কথার কোন মুল্য নেই। যদি কোন কমিটির মোড়ল, সর্দার, সদস্য, সম্পাদক, ক্যাশিয়ার বা সভাপতির উপরোক্ত যোগ্যতা না থাকে তাহলে তাদেরকে যোগ্যতা অর্জন করে নিতে হবে নতুবা কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে হবে। কোন কমিটি বা কমিটির সদস্যকে বার বার বোঝানো সত্বেও যদি তারা ইসলামের বিধান লংঘন করে, ইসলামী বিধানকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এবং জোর করে কমিটিতে থাকেন তাহলে সমগ্র সমাজের আবশ্যক কর্তব্য হলো তাদেরকে কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া। নতুবা সকলেই গোনাহগার হবে। সেক্ষেত্রে এরুপ কমিটির তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত কোন নামাযের জামাআতে ইমামতি করা বা নামায পাঠ করা মুমিনদের জন্য বৈধ নয়।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে সরল পথে অবিচল রাখুন । ওয়া মা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।