ইমান শব্দটির সংগে সকল মুসলিমই পরিচিত। ইমানের বিপরীত কুফর। ইমান সত্য, কুফর মিথ্যা। ইমান আলো, কুফর অন্ধকার। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল, আমাদের অনেকের নিকটই এ ধারণা স্পস্ট নয় যে ইমান কাকে বলে বা ইমানের হাকীকাত কি। কিছু লোক মনে করেন, নামায পড়া কিংবা রোযা রাখার নাম ইমান। আবার কিছু লোক মনে করেন, ফাতেহা-চল্লিশা-উরস করার নাম ইমান।
ইমানের আভিধানিক অর্থ হল বিশ্বাস করা বা আনুগত্য করা বা অবনত হওয়া বা নির্ভর করা ইত্যাদি। তবে ইমানের পারিভাষিক অর্থ ও ইমানের হাকীকাত হৃদয়ঙ্গমের জন্য বিষয়টি আমরা আল কুরআন ও হাদীসের আলোকে পরিবেশন করছি। সহীহ মুসলিমের হাদীসে ইমান বলতে ছয়টি বিষয়ের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। তবে সাধারণত হাদীস পাকটি আমরা গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করার চেস্টা করি না। ইমান বলতে ছয়টি বিষয়ের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, এটুকু ঐ হাদীসের একটি বিচ্ছিন্ন অংশ মাত্র। এই হাদীস শরীফেই ইসলামের পরিচয় দেওয়া আছে যা আমরা আলোচনাই নিয়ে আসি না। এ সম্পর্কে আরও রয়েছে আল কুরআনের একাধিক আয়াত ও অসংখ্য সহীহ হাদীস।
প্রথমেই আমরা আমরা সহীহ মুসলিমের হাদিস শরীফটি দেখে নেব। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বলেন, আমার পিতা ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ একদা আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামএর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আমাদের সামনে আবির্ভূত হলো। তার পরনের কাপড়-চোপড় ছিল ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো ছিল মিশমিশে কালো। সফর করে আসার কোন চিহ্নও তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। আমাদের কেউই তাঁকে চিনেও না। অবশেষে সে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সামনে বসলো। সে তাঁর হাঁটুদ্বয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাঁটুদ্বয়ের সাথে মিলিয়ে দিলো এবং দুই হাতের তালু তাঁর অথবা নিজের উরুর উপর রাখলো এবং বললো, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! আমাকে ইসলাম সম্বন্ধে বলুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ইসলাম হচ্ছে এই যে তুমি সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল, সলাত কায়িম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমাযানের সওম পালন করবে এবং যদি পথ অতিক্রম করার সামর্থ্য হয় তখন বাইতুল্লাহর হাজ্জ করবে। সে বললো, আপনি সত্যই বলেছেন। বর্ণনাকারী ‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বলেন, আমরা তাঁর কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হলাম। কেননা সে অজ্ঞের ন্যায় প্রশ্ন করছে আর বিজ্ঞের ন্যায় সমর্থন করছে। এরপর সে বললো, আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর প্রেরিত নাবীগণ ও শেষ দিনের উপর ঈমান রাখবে এবং তুমি তাকদীর ও এর ভালো ও মন্দের প্রতিও ঈমান রাখবে। সে বললো, আপনি সত্যই বলেছেন। এবার সে বললো, আমাকে ‘ইহসান’ সম্পর্কে বলুন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ‘ইহসান’ এই যে, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ‘ইবাদাত করবে যেন তাঁকে দেখছো, যদি তাকে না দেখো তাহলে তিনি তোমাকে দেখছেন বলে অনুভব করবে। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কিয়ামাত সম্বন্ধে বলুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি বেশি কিছু জানে না। অতঃপর সে বললো, তাহলে আমাকে এর কিছু নিদর্শন বলুন। তিনি বললেন, দাসী তাঁর মনিবকে প্রসব করবে এবং (এককালের) নগ্নপদ, বস্ত্রহীন, দরিদ্র, বকরীর রাখালদের বড় দালান-কোঠা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় গর্ব-অহংকারে মত্ত দেখতে পাবে। বর্ণনাকারী [‘উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ ] বলেন, এরপর লোকটি চলে গেলো। আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তারপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে ‘উমার! তুমি জান, এ প্রশ্নকারী কে? আমি আরয করলাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই অধিক জ্ঞাত আছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তিনি জিবরীল। তোমাদের কাছে তিনি তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।[ তথ্যসূত্রঃ সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ১ম খণ্ড, হাদীস নং ১]।
লক্ষ্য করুন , ইসলামের ভিত্তি কালেমা শাহাদাত এর মধ্যেই ইমানের হাকীকাত লুকিয়ে আছে। কালেমা শাহাদাত এর অর্থ ও তাৎপর্য সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করলে আমরা ইমানের হাকীকাত বুঝতে পারব। আমাদের আকা সাইয়িদুনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কালেমা শাহাদাত আমাদেরকে এভাবে শিখিয়েছেন, আশহাদু আল্লাইলাহা ইলল্লালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বান্দাহ ও রাসূল।
দেখুন, আপনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। একটু ভাবুন ! সাক্ষ্য কে প্রদান করে ? যে দেখে সেই সাক্ষ্য প্রদান করে। আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন যে আপনি আল্লাহর উলুহিয়াত বা উপাস্য হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন ? না। আসলে আমরা আল্লাহকে না দেখেই আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করছি। এটিই হচ্ছে ইমান বিল গাইব। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন – অর্থাৎ ‘‘তারাই, যারা না দেখে ইমান আনে।” {কানযুল ইমান, সুরা বাকারা, সুরা নং ২, আয়াত নং ৩]। তাহলে, আমরা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে ইমান কিসের ভিত্তিতে এনেছি ? উত্তর হলো, আমরা আল্লাহকে না দেখেই তাকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এক মহান ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে যিনি আল্লাহর হাকীকাতকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই মহান সত্বা সাইয়িদুনা রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কে সত্যবাদি সংবাদদাতা হিসেবে মেনে নিয়ে আল্লাহ পাককে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করার নামই ইমান। এখানে একটি সুক্ষ বিষয় সম্পর্কে সতর্ক থাকা জরুরী। যদি কেউ আমাদের আকা ও মাওলা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মাধ্যম ব্যতিরেকে অর্থাৎ তাকে সত্যবাদি সংবাদদাতা হিসেবে না মেনে নিজের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা বা দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের অনুসন্ধান অনুযায়ী আল্লাহকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে এর নাম ইমান নয়। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাক্ষ্যর উপর আমাদের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সাক্ষ্যই আমাদের সাক্ষ্য। এটিই ইমান। হুযুর কর্তৃক একত্ববাদের সাক্ষ্য দেওয়ার তাৎপর্য হলো, সমগ্র সৃষ্টিকুলে যত বস্তু এবং অস্তিত্ব রয়েছে, আমার হুযুর তার প্রতিটি অনুকনা প্রত্যক্ষ করেছেন, যাচাই করেছেন এবং গবেষণা করেছেন। তিনি মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলাকেও সরাসরি দেখেছেন এবং এর ভিত্তিতে দৃপ্তকন্ঠে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে সৃষ্টিকুলের কোন অস্তিত্বই উপাসনার উপযুক্ত নয়, কেবল আল্লাহ সুবহানাহু তাআলাই উপাস্য। সুতরাং, আমাদের ইমানের সূচনা হয় রাসুল পাকের প্রত্যক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে। যে সব বিষয় তিনি আমাদের নিকট পেশ করেছেন, না দেখে সেগুলোর উপর আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ইমান। আল্লাহ পাক বলেন, “ নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে [ হাজির ও নাজির রুপে] , সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর; আর সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর [ সূরা সূরাহ ফাতাহ, সূরা নং ৪৮, আয়াত নং ৮-৯] ।
সুতরাং, আল্লাহ পাক দ্বীন ইসলামকে প্রেরণ করেছেন তিনটি উদ্দেশ্যে । প্রথমত, মানব সম্প্রদায় যেন মহান আল্লাহ ও তার রসুল সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান নিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি মানুষেরা যেন সম্মান প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং তৃতীয়তঃ আল্লাহ পাকের উপাসনায় যেন মগ্ন হয়। আল্লাহ পাক কর্তৃক উদ্দেশ্য তিনটির মার্জিত ক্রম ও সুবিনস্ত্যকরনের প্রতি লক্ষ্য করুন ! মহান আল্লাহ সর্বপ্রথমে ঈমানের কথা, সর্বশেষে তাঁর (আল্লাহর) ইবাদতের কথা এবং মধ্যস্থলে প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি অসীম প্রেম বা সম্মান প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাক সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন যে, ইমান ও পরিত্রানের মূলভিত্তি বা প্রানশক্তি হল হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অসীম প্রেম ও শ্রদ্ধা। বহু ইহুদি-খ্রষ্টান হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং হুযুরের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখনী ও বক্তৃতা প্রদান করে, কিন্তু যেহেতু তারা ঈমান নিয়ে আসেনি সেহেতু তাদের এ সকল ক্রিয়া হল অনর্থক। অনুরুপ, হুযুরপাক সাল্লাল্লাহ আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা ব্যাতিরেকে যদি সারাজীবন পালন কর্তার ইবাদতে লিপ্ত থাকা হয়, তাহলেও সেই সকল ইবাদত হবে ব্যর্থ ও প্রত্যাবর্তিত। আল্লাহ পাক বলেন, “ বল, ‘তোমাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, স্ত্রী ও আত্মীয়গণ, অর্জিত ধনরাশি এবং সেই ব্যবসা-বাণিজ্য তোমরা যার ক্ষতি হওয়ার তোমরা আশংকা কর এবং প্রিয় বাসস্থানসমূহ যদি তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রসূল ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। বস্তুতঃ আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না [ সূরা তাওবা, সূরা নং ৯, আয়াত নং ২৪] । এই আয়াত কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না যে, কোন ব্যাক্তির নিকট তার প্রিয়জন, স্নেহভাজন, সম্পত্তি বা কোন বস্তু আল্লাহ তার রসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের তুলনায় যদি অধিক প্রিয় হয়, তবে তা আল্লাহর নিকট প্রত্যাখিত হবে এবং তাকে আল্লাহর আযাবের অপেক্ষায় থাকতে হবে?
আল্লাহ পাক বলেন, “ যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে [ সূরা মুজাদিলাহ, সূরা নং ৫৮, আয়াত নং ২২]। আল্লাহ পাক আরও বলেন, হে ঈমানদারগণ! আপন পিতা ও নিজ ভাইদের অন্তঃরঙ্গ মনে কর না যদি তারা ঈমানের উপর কুফরীকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে এবং তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তারাই পাপাচারী [ সূরা তাওবা, সূরা নং ৯, আয়াত নং ২৩ ]। হযরত আনাস থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশী প্রিয় হই [ সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইমান, বাব হুব্বুর রসূল মিনাল ইমান, হাদীস নং ১৪, ইসলামিক ফাঊন্ডেশন]। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, বর্ননাকারী বলেন, একদিন আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। নবীজী ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাত ধরা ছিলেন। ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার কাছে সবকিছু থেকে প্রিয়, তবে আমার জান ছাড়া। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার নিয়ন্ত্রনে আমার জান তাঁর কসম! ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ বললেন, হাঁ এখন তা হয়েছে; আল্লাহর কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ ওমর! এখন হয়েছে [ তথ্যসূত্রঃ সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৩২] ।
তাহলে গুলামীয়ে রসূল, ইশকে রসূল ও তাজীমে রসূল ইমানের প্রানশক্তি হল কি না? উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম হাফেয ইমাম আহমাদ রাযা খান রহিমুহুল্লাহ স্বীয় অনুনকরণীয় ও অনুপম শৈলীতে দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন , হুযুর তো পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন যে হযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর চেয়ে অন্য কারও সহিত অধিক ভালবাসা স্থাপনকারীরা অবশ্যই মুসলমান নয়। মুসলমানগণ! বল, সারা বিশ্ব জাহানের চেয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের প্রতি অধিক ভালবাসা স্থাপন ঈমানের ও নাজাতের মূল হল কী না ? তুমি যাকে যতই শ্রদ্ধা করা, যতই সম্মান কর, যতই বন্ধুত্ব রাখ অথবা যতই ভালবাসার সম্পর্ক রাখ যেমন তোমার বাবা-মা, তোমার শিক্ষক, তোমার পীর, তোমার সন্তান, তোমার ভাই, তমার সহপাঠী, তমার শ্রদ্ধাভাজন, তোমার সাথী, তোমার মৌলবী, তোমাদের হাফেজ, তোমাদের মুফতী, তোমাদের বক্তা প্রমূখ যে কেহ যদি হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের প্রতি গুস্তাখী বা বে-আদবী করে, তাহলে তোমার অন্তরে যেন তাদের জন্য কোনরূপ ভক্তি বা ভালবাসার চিহ্ন না থাকে, তাদের হতে অবিলম্বে দূরে চলে যাও। তাদের কে দুধ হতে মাছিকে বের করার ন্যয় বের করে দাও। তাদের আকৃতি ও আকারকে ঘৃনা কর। তাদের মৌলবী, মাশায়েখ, বুজুগী ও ফাজিলতের খাতির যেন না হয়। একমাত্র হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলায় হে ওয়া সাল্লামের সহিত গোলামীর ভিত্তিতেই সম্পর্ক থাকে! কেহ যখন তাঁর শানের গুস্তাখী করল, তখন সম্পর্ক আবার কিসের রইল ? তাদের জুব্বা পাগড়ীতে কি আসে যায় ? অধিকাংশ ইহুদীরা কি এরূপ পরিধান করে না? তাদের নাম ও খ্যাতিতে কি হবে ? অধিকাংশ পাদরী, বহু দার্শনিক বৃহৎ বৃহৎ অজ্ঞান ও শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞাত কি নয় ? যদি অজুহাত দেখিয়ে হুযুরের শানে যে বেয়াদবি করল তুমি তার সাথে বন্ধুত্ব করলে বা এ বিষয়টিকে এড়িয়ে গেলে বা তোমার অন্তরে তার প্রতি কঠোর ঘৃনা জন্মালনা, তাহলে তুমি নিজেকে প্রশ্ন কর- “তুমি ঈমানের পরীক্ষায় পাশ করবে কি ভাবে?” কোরান ও হাদিস যার উপর ঈমানের নির্ভরতা ঘোষনা করছে, তুমি তার হতে কত দূরে চলে গেছ!
রবিউল|আমরা ছিলাম পথহারা, দিশেহারা। হেদায়াত ও সফলতার পথ সম্পর্কে ছিলাম অজ্ঞ। অতপর মহান রাব্বুল আলামীন হেদায়েতের বার্তা দিয়ে প্রেরণ করলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনি এসে আমাদেরকে সত্য-মিথ্যা চিনিয়েছেন। আমাদের নিকট সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নাজাতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পন্থা শিখিয়েছেন। এ ছিল আমাদের প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ। আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রকৃত ইমানদার হয়ে মৃত্যু বরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন!
মুফতি আবুল কালাম আযাদ
লেখক ও গবেষক মালদহ পশ্চিমবঙ্গ
মুঠোফোন ৮০০১৬০৫৫১৫ Email mdakazad786@gmail.com