বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার । তিনি একমাত্র উপাস্য। তিনি একমাত্র প্রকৃত্ব সার্বভৌমত্বের অধিকারী । তিনি একমাত্র প্রকৃত সাহায্যকারী । তিনি একমাত্র প্রকৃত মালিক। অসংখ্য সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবীকূলসম্রাট দোজাহানের সর্দার হুযুর সাইয়িদূনা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উপর এবং আল্লাহ পাকের দয়া ও শান্তি আরও বর্ষিত হোক পুত-পবিত্র আহলে বাইত এবং সাহাবায়ে কেরামের উপর। আসস্বলাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ !
আজ আমরা শাওয়াল মাসের ফাজিলাত ও গুরুত্ব আলোচনা করব। শাওয়াল মাস ইসলামিক পঞ্জিকার দশম মাস। শাওয়াল’ আরবি শব্দ। নামের অর্থ থেকেই শাওয়াল মাসের নামের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়। ‘শাওয়াল’ এর অর্থ হলো উঁচু করা, উন্নতকরণ বা পূর্ণতা। এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী। একদিকে এই মাসের সঙ্গে ইদের বা আনন্দের সম্পৃক্ততা রয়েছে, অন্যদিকে এর সঙ্গে পবিত্র রোযা এবাদাতের সম্পৃক্ততা রয়েছে । আবার অন্যদিকে এর সঙ্গে পবিত্র হজের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফলে এই মাসের আমল দ্বারা যেমন গৌরব, সাফল্য এবং আনন্দ অর্জিত হয়, অনুরুপ এই মাসে আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি, পরিপক্বতা ও স্থিতি লাভ কররা যায়। এটি হজের তিন মাস তথা শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ-এর প্রথম মাস; এবং হারাম বা সম্মানিত চার মাসের একটি হলো শাওয়াল। এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে ঈদের; এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রোজা ও রমজানের এবং এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সদাকা ও জাকাতের। তাই এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী।
সম্মানিত ভাইসকল, শাওয়াল মাস এর ফাজিলাত সম্পর্কে আমরা দুটি বিষয় সকলেই জানি। এক, রমজান এর দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাস আমাদের জন্য ইদ উল ফিতরের খুশি নিয়ে আসে এবং দুই, শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোযা রাখার উপর বিশেস গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবে শাওয়াল মাসের আরও কিছু গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক তাতপর্য রয়েছে।
প্রথমত, এ মাসে যেমন নফল রোযা রাখার কথা বলা হয়েছে অনুরুপ আমরা চাইলে এ মাসে নফল ইতেকাফও করা যেতে পারে। ইসলামে ইতেকাফ এর গুরুত্ব অপরিসিম । কারন আত্মার উতকর্স সাধনের জন্য, একাকিত্বের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে একান্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে কবরে একা থাকার জন্য নিজেকে প্রস্ত্তত করে তুলার জন্য ইতেকাফ একটি বড় মাধ্যম। দোজাহানের সর্দার হুযুর সাইয়িদূনা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একবার রমজান মাসে ইতেকাফ ছুটে গেলে শাওয়াল মাসে তিনি ইতেকাফ পালন করেন [ তথ্যসূত্রঃ সহীহ মুসলিম – কিতাবুল ইতেকাফ – হাদিস নং ২৫৫৬ ]। ইতেকাফ এর অর্থ অবস্থান করা বা নিজেকে কোনো স্থানে আবদ্ধ করে রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় কতগুলো বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। ইতেকাফ এর জন্য নিয়ত করতে হয়, রোজা রাখতে হয়, সুস্থ হতে হয় এবং কোনো নির্দিষ্ট মসজিদে অবস্থান করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, ইসলামে যদিও বছরের যেকোনো মাস বা যে কোনো দিন বিয়ের দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করা জায়েজ, তবে শাওয়াল মাসে বিবাহ অনুষ্ঠান বিশেষ বরকতময়। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল শাওয়াল মাসে এবং আম্মাজান নবীজির ঘরে আগমনও করেছিলেন এই মাসে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা স্বয়ং বলেন—‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাকে শাওয়াল মাসেই বিয়ে করেছেন, শাওয়াল মাসেই বিয়ে-রজনী উদযাপন করেছেন। অথচ তার অনুগ্রহ লাভে আমার চাইতে সৌভাগ্যবতী স্ত্রী আর কে আছে? আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার বংশের মেয়েদের শাওয়াল মাসে বাসর ঘরে পাঠানো উত্তম মনে করতেন। [ সহিহ মুসলিম, ইফা, হাদিস নং ৩৩৫২]। এছাড়া আম্মাজান খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ইনতেকালের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বিবাহ করেন ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে। হযরত সাওদাহ বিনতে যাম‘আহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ও তার পূর্ব স্বামী সাকরান বিন আমর উভয়ে ইসলাম কবুল করার পর হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখানেই অথবা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে তার স্বামী ইনতেকাল করেন। এ সময় মৃত স্বামীর পাঁচটি বা ছয়টি সন্তানের গুরুভার এসে পড়েছিল সওদার উপরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তার সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বসহ সওদাকে বিয়ে করেন [ আহমাদ নিন হাম্বল – হাদিস নং ২৯২৬ ]।
তৃতীয়ত, তবে সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো শাওয়াল মাসের ঐতিহাসিক তাতপর্য ও সেখান থেকে আমাদের শিক্ষাগ্রহন । এই মাসেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রিয় চাচা আবু তালিব মৃত্যুবরন করেন। আবু তালিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, নবীজির রক্ষাকবচ হয়ে ছিলেন। তার মৃত্যুর পরেই মক্কার কুরাইশদের উৎপীড়ন বেড়ে যায়। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর নিকট সর্বাধিক কষ্টদায়ক ছিল, মৃত্যুর সময় আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ না করা। এই শাওয়াল মাসেই সংঘটিত হয়েছিল মুসলমান ও কাফিরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক ওহুদ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল এক চরম পরীক্ষা ও মুসিবতের দিন। এর দ্বারাই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের পরীক্ষা ও মুনাফিকদের ছাঁটাই-বাছাই করেছিলেন। যারা মুখে ইমানের দাবি করত, কিন্তু মনে মনে গোপন কুফরি ধ্যান-ধারণা লালন করত, এদিন তারা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। আর আল্লাহ তাঁর যেসব বান্দাকে শাহাদাতের সম্মানে ভূষিত করতে চেয়েছিলেন, এদিন তাদের শাহাদাত প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছিলেন। দ্বিতীয় হিজরিতে হক ও বাতিল, ইমান ও কুফরের মধ্যে সংঘটিত হয় প্রথম যুদ্ধ ‘বদর’। যাতে মক্কার কুরাইশ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে মুসলিম বাহিনীর হাতে, যেখানে তাদের ৭০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি নিহত হয় এবং সমপরিমাণ লোক মুসলিম মুজাহিদদের হাতে বন্দি হয়। এ নির্মম ও অপমানজনক ও শোচনীয় পরাজয়টি ছিল শত্রুপক্ষের জন্য প্রথম। যা কুরাইশদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। নিহত কুরাইশদের স্বজনরা গোটা আরবগোষ্ঠীর অন্তরে জাগিয়ে তোলে ক্ষোভের সুনামি। সেজন্য তারা প্রতিজ্ঞা করে, ‘যতদিন এ লজ্জাজনক নির্মম পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ না করতে পারব, ততদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেব না।যুদ্ধক্ষেত্রে অহুদের যুদ্ধেও মুসলিম বাহিনী কাফের বাহিনীর উপর বিজয় লাভের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু চরম মুহুর্তে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পালনে ত্রুটি দেখানোয় শেষ পর্যন্ত সাফল্য মুসলিম বাহিনীর অধরা থেকে যায়। এই ত্রুটির কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুদ্ধখেত্রে আহত হন । অহুদের যুদ্ধ মুসলমান্দেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে , মুসলিম দের সাফল্য নির্ভর করছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পালনে অবিচল থাকার উপরে এবং মহান আল্লাহ পাকের উপর অটল তাওয়াককুল বজায় রাখার ক্ষেতে ।
তবে ওহুদের যুদ্ধের আর একটি অনন্য দিক রয়েছে। তা হলো ইসলামের ক্ষমার দিক। ইসলামের হিউম্যান রাইটস বা মানব অধিকার এর দিক । প্রায় সকলেই জানেন যে অহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর প্রানপ্রিয় চাচা হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ শহীদ হয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ৫৯ বছর। বদর এর যুদ্ধে মক্কার একজন বিশিষ্ট কাফের তুআইম ইবনে আদিকে হামজা হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ হত্যা করেন । নিহত ব্যক্তির ভাতিজা জুবাইর ইবনে মুতইম তার দাসকে মুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহকে শহীদ করায়। কাফিররা হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ শহীদ করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং তাঁর লাশের সঙ্গে নির্মম আচরণও করে। কাফেরদের নেতা আবু সুফিয়ান এর স্ত্রী হিন্দাহ বিনতে উতবা তাঁর নাক-কান কেটে তাঁর চেহারাকে বিকৃত করে। বুক-পেট চিরে কলিজা বের করে। ক্ষো ভে-ক্রোধে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ফেলে। কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্য দেখুন, এই আবু সুফিয়ান এর স্ত্রী হিন্দাহ বিনতে উতবা যখন ইসলাম গ্রহন করেন তখন তারা ইসলাম তাদের পূর্ব কৃত অপরাধের জন্য কোনপ্রকার অবমাননা করে নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে সসম্মানে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় প্রদান করেন এবং তাদেরকে উপযুক্ত মান মর্যাদা প্রদান করেন। হযরত আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ এবং তার স্ত্রী হিন্দাহ বিনতে উতবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা অবশিষ্ট জীবন ইসলামের সেবায় কাটিয়ে দেন । তাদেরই সন্তান হলেন সাইয়িদূনা হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ। কিছু লোক ইয়াজিদের কুকর্মের জন্য সাইয়িদূনা হযরত আমির মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহ এর শানে বেয়াদবি করে। এ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম হচ্ছেন সত্যের মাপকাঠি। সাহাবায়ে কেরাম হচ্ছেন হকের মাপকাঠি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এর কোন সাহাবির শানে বিন্দুমাত্র বেআদবি আমাদের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কঠোর ভাষায় সতর্ক করে বলেনঃ
لله الله فى أصحابى لا تتخذوهم غرضا من بعدى فمن أحبهم فبحبى أحبهم ومن أبغضهم فببغضى أبغضهم
অর্থাৎ সাবধান!তোমরা আমার সাহাবীগণের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। আমার পরে তোমরা তাঁদেরকে (তিরস্কারের) লক্ষ্যবস্তু বানাইও না। যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে সে আমার প্রতি ভালোবাসা বশেই তাঁদেরকে ভালোবাসে। আর যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতি বিদ্বেষবশতঃ তাঁদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে [ তিরমিযী, হাদিস নং ৩৮৬১ ]।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে হক পথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।