বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার । তিনি একমাত্র উপাস্য। তিনি একমাত্র প্রকৃত্ব সার্বভৌমত্বের অধিকারী । তিনি একমাত্র প্রকৃত সাহায্যকারী । তিনি একমাত্র প্রকৃত মালিক। অসংখ্য সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবীকূলসম্রাট দোজাহানের সর্দার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উপর যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ পাক কিছুই সৃষ্টি করতেন না । আল্লাহ পাকের দয়া ও শান্তি আরও বর্ষিত হোক পুত-পবিত্র আহলে বাইত এবং সাহাবায়ে কেরামের উপর। আসস্বলাতু ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া রসূলাল্লাহ !
হে পরকালের মুসাফির প্রিয় ভাই ও প্রিয় বোন, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর মাহবুব নবীকূলসম্রাট হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে কুরআন পাকে বলেন,
وَ اِذۡ اَخَذَ رَبُّکَ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اٰدَمَ مِنۡ ظُهُوۡرِهِمۡ ذُرِّیَّتَهُمۡ وَ اَشۡهَدَهُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ ۚ اَلَسۡتُ بِرَبِّکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی ۚۛ شَهِدۡنَا ۚۛ اَنۡ تَقُوۡلُوۡا یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اِنَّا کُنَّا عَنۡ هٰذَا غٰفِلِیۡنَ
অনুবাদঃ আর হে মাহবূব, স্মরণ করুন! যখন আপনার রব আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরগণকে বের করেছেন এবং তাদের নিজেদের উপর নিজেদেরকে সাক্ষী করেছেন- ‘আমি কি তোমাদের রব নই’? সবাই বললো, ‘কেন নন? (নিশ্চয়) আমরা সাক্ষী হলাম’ (এ স্বীকৃতি গ্রহণ এ জন্য) যে, তোমরা যেন ক্বিয়ামতের দিন না বলো-‘আমরা তো সে বিষয়ে অবগত ছিলাম না;’ [ আল কুরআন, সুরা আরাফ- সুরা নং ৭, আয়াত নং ১৭২ ]
কিন্তু ব্যস্ততম বস্তুবাদী পৃথিবীর মোহমায়ায় নিমগ্ন হে প্রিয় ভাই ও প্রিয় বোন! তুমি রূহের জগতে তোমার রবকে দেওয়া তোমার প্রতিশ্রুতি তুমি ভুলে গেছো! সাইয়িদুনা হযরত যুননুন মিসরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হ বলেছেন, এই প্রতিশ্রুতির কথা আমার এমনভাবে স্মরণ আছে, যেন এখনও শুনছি। তোমার রবের বহু প্রেমিক একথাও বলেছেন যে, স্বীকারোক্তি গ্রহণের সময় আমার আশেপাশে যারা ছিলো তাও আমার স্মরণ আছে। একথা ঠিক, আল্লাহর এমন প্রেমিকের সংখ্যা একান্তই বিরল। কিন্তু যারা সাধারণ প্রেমিক, তাদের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ না থাকলেও ঐ প্রতিজ্ঞা প্রতিশ্রুতির প্রভাব তাদের উপর সুস্পষ্টভাবে থেকে যায়। ঐ স্বীকারোক্তি তাদের মনে আল্লাহ প্রেমের এমন বীজ রোপণ করে দেয়, যা ক্রমান্বয়ে লালিত হয়। কিন্তু তুমি কি সেই হতভাগাদের দলভুক্ত, যাদের প্রকৃতি বিকৃত হয়ে গিয়ে তাদের জ্ঞান ও রুচিবোধ বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং জৈবিক কামনা-বাসনায় মোহিত হয়ে এবং কলুষিত ভ্রষ্ট সমাজ পরিবেশের কবলে পড়ে নিজের সহজাত বৃত্তিকে ভুলে গেছে ? এ পৃথিবীতে যা কিছু দেখছো সবই আল্লাহর অস্তিত্বের নমুনা। সবই আল্লাহর। এ মহান আল্লাহকে পাওয়ার জন্য তোমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে না ? তোমার হৃদয় কি মৃত ? মহান আল্লাহ যে তোমাকে কুকুর-ছাগল না বানিয়ে মানুষ বানিয়েছেন, আল্লাহ পাকের গুলামীর জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয়? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর নায়ক শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর কত সুন্দরই না বলেছেনঃ
‘‘কার নাহ্ শিকোয়াহ্, কে মুঝে এহ্ নাহ দিয়া, ওহ নাহ দিয়া,
শুকর কার তু কে, তুঝে ইনসান বানা দিয়া।’’
হে পরকালের মুসাফির প্রিয় ভাই ও প্রিয় বোন, এ ধরায় আগমণ করে তুমি নিজের আসল বাড়িকেও ভুলে গেছো, যেখানে তোমার আত্মা অন্যান্য মানব আত্মার সঙ্গে মহান আল্লাহর নৈকট্যে স্থায়ী শান্তির মধ্যে বসবাস করছিলো ? পার্থিব বস্তুর ভালোবাসার প্রভাবে তুমি কি আল্লাহর ভালোবাসা ভুলে গেছো ? তুমি কি ভুলে গেছো রূহের মানোরম জগতকে যেখানে তোমার আত্মা আল্লাহর পবিত্র ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিলো ? তুমি কি তোমার রুহের কান্না শুনতে পাচ্ছো না? তোমার রূহ এ ধরায় এসে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে নিপতিত হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য সর্বদা কাঁদছে। কিন্তু দুনিয়ার লালসায় পড়ে তুমি তোমার রূহের কান্না শুনতে পাচ্ছো না। দুনিয়ার ধন-দৌলতের লালসা, খ্যাতির লালসা, প্রভাব-প্রতিপত্তির লালসা তোমার আর তোমার রূহের মধ্যে হিমালয়সম এক প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছে। হে প্রিয় ভাই ও প্রিয় বোন। কাঁদো ! কাঁদো ! খু-উ-ব কাঁদো ! তোমার কান্নার পরশে ঐ হিমালয়সম প্রাচীর গলে নির্মূল হয়ে যাবে। আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, فَإِنَّ العَبْدَ إِذَا اعْتَرَفَ ثُمَّ تَابَ، تَابَ اللَّهُ عَلَيْه অর্থাৎ ‘‘বান্দা গোনাহ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ পাক তা কবুল করেন।’’ (সহীহ বুখারী – হাদীস নং ৪১৪১) । হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “দুনিয়া হলো মৃত জিনিস যা শুধু কুকুররাই চায়।’’ (কানযুল উম্মাল – খন্ড নং ৩, পৃষ্ঠা নং ২০১৪) আল্লামা ইকবাল রাহমাতু্ল্লাহি আলায়হ বলেছেন – ‘‘কাফেরের পরিচয় হলো, সে হারিয়ে গেছে পৃথিবীতে আর মুমিনের পরিচয় হলো, পৃথিবী হারিয়ে গেছে তাতে।’’
হে পরকালের মুসাফির প্রিয় ভাই, আল্লাহ পাক পরম দয়ালু। তাওবা করলে তিনি সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেন। আমার আকা নবীকূলসম্রাট হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنِّى لِأَعْلَمُ آخِرَ أَهْلِ الْجَنَّةِ دُخُولًا الْجَنَّةَ وَآخِرَ أَهْلِ النَّارِ خُرُوجًا مِنْهَا رَجُلٌ يُؤْتٰى بِه يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُقَالُ اعْرِضُوا عَلَيْهِ صِغَارَ ذُنُوبِه وَارْفَعُوا عَنْهُ كِبَارَهَا. فَتُعْرَضُ عَلَيْهِ صِغَارُ ذُنُوبِه فَيُقَالُ عَمِلْتَ يَوْمَ كَذَا وَكَذَا كَذَا وَكَذَا وَعَمِلْتَ يَوْمَ كَذَا وَكَذَا كَذَا وَكَذَا. فَيَقُولُ نَعَمْ. لَا يَسْتَطِيعُ أَنْ يُنْكِرَ وَهُوَ مُشْفِقٌ مِنْ كِبَارِ ذُنُوبِه أَنْ تُعْرَضَ عَلَيْهِ. فَيُقَالُ لَه فَإِنَّ لَكَ مَكَانَ كُلِّ سَيِّئَةٍ حَسَنَةً. فَيَقُولُ رَبِّ قَدْ عَمِلْتُ أَشْيَاءَ لا أَرَاهَا هَا هُنَا. فَلَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ ضَحِكَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُه
‘‘নিশ্চয় আমি সেই জান্নাতী ব্যক্তি সম্পর্কে জানি, যে সবার শেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সবার শেষে জাহান্নাম থেকে বের হবে। সে এমন এক ব্যক্তি, যাকে ক্বিয়ামাতের দিন হাজির করা হবে এবং বলা হবে, ‘ওর ছোট-ছোট পাপগুলো ওর কাছে পেশ কর এবং বড়-বড় পাপগুলো তুলে নাও।’ তারপর তার ছোট-ছোট পাপগুলো তার কাছে পেশ করা হবে এবং বলা হবে, ‘তুমি অমুক দিনে এই পাপ করেছ, অমুক দিনে এই এই পাপ করেছ? সে বলবে, হ্যাঁ। সে তো অস্বীকার করতে পারবে না। সে তার বড় পাপগুলো পেশ করার ভয়ে ভীত থাকবে। অতঃপর তাকে বলা হবে, ‘তোমার প্রত্যেক পাপের স্থলে একটি করে পুণ্য দেয়া হল।’ তখন সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমি তো অনেক কিছু (এমন পাপ) করেছি, যা এখানে আমি দেখতে পাচ্ছি না।’ এ ঘটনা বর্ণনা করে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে হেসে ফেললেন যাতে তাঁর মাড়ির দাঁতগুলো প্রকাশিত হয়ে গেল।’[ তথ্যসূত্রঃ সহীহ মুসলিম : ৪৮৭ ]। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা তাওবাহ করলে আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির চাইতেও বেশী খুশী হন, যে ব্যক্তি তার উটকে মরুভূমির অজানা পথে হারিয়ে ফেলে। চিন্তায় মুমূর্ষ হয়ে পড়েছে; ঠিক এই মুহুর্তে সে তার উটকে পেয়ে গেলে যতটা খুশি হয়। হাদিসের ভাষায়ঃ
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : «للَّهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ، سَقَطَ عَلَى بَعِيرِهِ، وَقَدْ أَضَلَّهُ فِي أَرْضِ فَلاَةٍ». وفي رواية: «لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ، مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً، فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا، وقَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا، قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ: اللهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ! أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَح»
অনুবাদঃ আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফু হিসেবে বর্ণিত, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দার তওবা করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট জঙ্গলে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়।’’ অপর বর্ণনায় এসেছে, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবায় যখন সে তওবা করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশী হন, যে তার বাহনের উপর চড়ে কোনো মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানীয় সব ওর পিঠের উপর থাকে। অতঃপর বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি হঠাৎ তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশীর চোটে বলে ওঠে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার দাস, আর আমি তোমার প্রভু!’ সীমাহীন খুশীর কারণে সে ভুল করে ফেলে [ তথ্যসূত্রঃ সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩০৯]।
কিছু লোক বলেন যে, আল্লাহ পাক শির্কের গুনাহ মাফ করবেন না। কথাটি ঠিক নয়। যদি বান্দাহ তাওবা করে তাহলে আল্লাহ পাক মাফ করেন। হাফেয ইমাম ইভনে কাসির বলেন যে, “ আল্লাহর অপার রহমত যে, তিনি বান্দার শির্কের পরও যদি তাঁর কাছে তাওবাহ করে তবে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিবেন” [ তাফসীরে যাকারিয়া [সালাফী তাফসির], সূরা মায়েদার ৭৪ নং আয়াতের টীকা ]।
হে পরকালের মুসাফির প্রিয় ভাই বোন, আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। কেবল আমাদের তওবা করার প্রতীক্ষা! আসুন, আমরা তাওবা করি এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা, তাজীম ও আনুগত্যে নিজেদেরকে রঞ্জিত করে পরকালের প্রস্তুতি আরম্ভ করি। আল্লাহ আমাদেরকে সকলকে সিরাতাল মুসতাকিম অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন! আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন